নিলোৎপল বড়ুয়া

আবারও উঠলো সেই কথাগুলো ; বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষক আর সাধারণ বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকের মধ্যে যোগ্যতার তুলনা। কথাগুলো প্রথমে প্রবলভাবে উঠেছিল প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রতি উপজেলায় একটি করে কলেজ সরকারীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আত্তীকরণ নিয়ে। এখন আবার উঠেছে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে।
এটা তো অস্বীকার করার কোন কথা না যে বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চেয়ে একটি ক্ষেত্রে অধিকতর যোগ্যতার সম্মানজনক দাবিদার। তাঁরা বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষক। তাই বলে কি তাঁরা সবদিক দিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের চেয়ে প্রশ্নাতীতভাবে অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন? অথবা এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা কি সবদিক দিয়ে তাঁদের চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন? কথাটা এত সরলীকরণ করে বলা যাবে না। যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি কিন্তু বিসিএস/পিএসসি পরীক্ষা নয়। ভালো-মন্দ উভয় ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। তবে ঢালাওভাবে এমপিওভুক্ত সাধারণ শিক্ষকদের অযোগ্য বলাটা অপমানজনক। এটা ঠিক নয়। বরং দেশের শিক্ষা বিস্তারে তাঁদের অবদান কোন কোন দিকদিয়ে বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষকদের চেয়েও নিঃসন্দেহে বেশি।
বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অবদান সম্মাজনকভাবে মাথার উপর রেখে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অবদানের হিসাবটা নির্মোহভাবে করে দেখা যেতে পারে। বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষকদের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও বাংলাদেশের স্বীকৃত একইরকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান/ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মানুষ। হয়ত পাশের রেজাল্ট বা নম্বরে একটু কম-বেশি। পরীক্ষার রেজাল্টই যে একজন মানুষের একমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠি আধুনিক “শিক্ষার ধারণা” তা কখনই সমর্থন করে না। শুধু পরীক্ষা পাশের বই মুখস্থ করে ভালো রেজাল্ট করা যায়। তো ক্লাসের পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় কম ভালো করেছে যে সমস্ত শিক্ষার্থী মঞ্চে, খেলার মাঠে, রাজ পথে, প্রতিবাদ প্রতিরোধে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও লেখালেখির জগতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে সে যোগ্যতার নম্বর কই? শিক্ষকতার যোগ্যতা কিন্তু কেবল চাকরির পরীক্ষা দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না। একজন শিক্ষকের কাজ বহুমুখী ও বিচিত্র।
যোগ্যতার শিক্ষক যাঁরা তাঁরা কিন্তু বিসিএস/পিএসসি পাশ করেই শহরের কোন সরকারি স্কুল-কলেজে যোগ দেন যেখানে দেশের মোট শিক্ষার্থীর দশ শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী পড়ে আর তারা হলো অগ্রসর শিক্ষার্থী। আর বাকি নব্বই শতাংশেরও অধিক অনগ্রসর, দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীকে শিখিয়ে পড়িয়ে যোগ্য করে তোলেন, দেশের মানব সম্পদে পরিণত করেন এই অযোগ্য বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। এই অযোগ্যরা আছেন বলেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামে-গঞ্জে সমাজের মানুষের দানে-দক্ষিণায় স্কুলকলেজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে আর এই অযোগ্যরা সেখানে খেয়ে না খেয়ে, একপ্রকার বেতনহীন শিক্ষকতা করেছেন বলেই বাংলাদেশে এতোগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, শিক্ষা বিস্তার হয়েছে আর রাষ্ট্র দেশের শিক্ষার হার নিয়ে সন্তুষ্টির ঢেকুর তুলতে পারছে। বিসিএস/পিএসসি পাশ করা যোগ্যরা তো সবাই শহরের সরকারি স্কুল-কলেজে নিরাপদ বেতনে যোগদান করেন। তো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কয়টি? তাঁরা দেশের জনগণের কত শতাংশ সন্তানদের শিক্ষিত করার কাজ করেন? কয়টি স্কুলকলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁদের অবদান থাকে?
এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই যে আমাদের সমাজে সরকারি স্কুলকলেজের শিক্ষকের চেয়ে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জনসম্পৃক্ততা বেশি। সামাজিক সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজ কর্মে মানুষ তাঁদেরকেই কাছে পান বেশি এবং তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যদিয়ে তাঁরা দেশে কি পরিমাণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক অবদান রেখে চলছেন তার হিসাব কি কেউ কখনো করে দেখেছেন!
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও কিন্তু রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত যথাযথ বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। দুয়েকটা ক্ষেত্রে যে কিছু ব্যত্যয়, বিচ্যুতি ঘটে তা অস্বীকার করা যাবে না। অনেক আগে কিছু শীতল প্রক্রিয়া ছিল। তখন কোন চৌধুরী সাহেব, মিয়া সাহেব, কোন দানবীর বাবু বা সমাজের কিছু মানুষ মিলে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্কুল কলেজ স্থাপন করতেন যার কোন চালা, বেড়া ঠিক থাকত না। আর এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে মাস্টারি করার জন্য তাঁরা বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষক কোথায় পাবেন! তাই তাঁরা সারা গ্রামজুড়ে কলিমুদ্দিন-ছলিমুদ্দিনের বিশ্ববিদ্যালয় পাশকরা ছাওয়ালটাকে বা কোন মিয়া-চৌধুরী-বাবুর বিএ পাশ করা ছেলেটাকে অনুরোধ করে এসমস্ত প্রতিষ্ঠানে মাস্টারি করতে দিতেন। তারপর তাঁদের মাস্টারির উপর ভরদিয়ে চলতে থাকা এই ইশকুল কলেজগুলো সমাজে আলো ছড়াতে থাকে। সেখান থেকেই গড়ে উঠে আসে আজকের বিসিএস/পিএসসি পাশকরা অনেক যোগ্য শিক্ষক আর সেই প্রথম দিকের শিক্ষকরা মাস্টারির নেশায় পড়ে আর কোথাও যান না। সে স্কুল-কলেজেই থিতু হয়ে যান শেষ পর্যন্ত। তো কোন যোগ্যতা বলে এসব শিক্ষকদের অযোগ্য বলা যায়? অনেক সময় এমপিও না হওয়া পর্যন্ত তাঁদেরকে বিনা বেতনে কাজ করতে হয়। এই যে বিনা বেতনে কাজ করার মানুষ পাওয়ার কারণেই বাংলাদেশে আজ এতগুলো বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুল কলেজ গড়ে উঠেছে, এতগুলো ছেলে-মেয়ে শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, সমাজ রাষ্ট্র অগ্রসর হয়েছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যাদের পড়ান তারা বেশিরভাগ সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সন্তান। তারাও তো বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষকদের সরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে একই প্রক্রিয়ায়, একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বোর্ড নির্ধারিত মানে পাশ করছে। তো বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যদি শিক্ষকতায় ঢালাওভাবে অযোগ্য হতেন তাহলে কী এটা সম্ভব হতো? তবে কিছু ভালো-মন্দ সব জায়গায় থাকে। বিসিএস /পিএসসি পাশ করা সবাই কি ভালো শিক্ষক? এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে প্রতিকূল পরিবেশে, যে মানের শিক্ষার্থীদের ঐ শিক্ষকরা পাঠ দান করেন, বিসিএস/পিএসসি পাশ করা শিক্ষকরা তা কল্পনাও করতে পারবেন না। শুধু বিসিএস/পিএসসির পরীক্ষা পাশকরা শিক্ষকরা যোগ্য আর এমপিওভুক্ত বেসরকারি সাধারণ শিক্ষকরা অযোগ্য, এটা বলা কখনোই ঠিক নয়। এরপরও যদি তাঁদের অযোগ্য বলা হয়, তাহলে বলতে হয়, এই অযোগ্য বেসরকারি এমপিওভুক্ত সাধারণ শিক্ষকদের জন্যই দেশের অন্ধকার জনপদগুলো আজ আলোর মুখ দেখেছে।